রিয়াদ হায়দার, মদিনা শরীফ থেকে:
মদিনা মোনাওয়ারা। নান্দনিক আলোকিত শহর। ইসলামের পবিত্রতম দ্বিতীয় শহর। যেখানে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরত করেছেন। এই শহরেই তাঁর রওজা মোবারক ।

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে পরম বিশ্বস্ত সাহাবি হজরত আবু বকর সিদ্দিক
রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। এখানের মাটি ও মানুষ কঠিন দুর্দিনে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মদিনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের শেষ ১০টি বছর কাটিয়েছেন। ইসলাম বিশ্বময় বিস্তৃত হয়েছে মদিনাকে কেন্দ্র করে।

মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব ৪২৩ কিলোমিটার। মদিনা যাওয়ার রাস্তাটি চার লেনবিশিষ্ট একমুখি সড়ক। যেতে সময় লাগে ছয় ঘণ্টার মতো।

মদিনার প্রাচীন নাম ইয়াসরিব। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনানন্দে উদ্বেলিত জনতা নিজ শহরের নাম বদলে রাখেন- মদিনাতুন নবী, অর্থাৎ নবীর শহর।

মক্কা মদিনার পথে কয়েক কিলোমিটার পর পর রয়েছে যাত্রাবিরতির ব্যবস্থা। রয়েছে মসজিদ, খাবারের হোটেল। রাস্তার দুই ধারে কেবল ধু-ধু মরুভূমি। পাহাড় কেটে মাঝখান দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। পথ চলতে কখনও কখনও উট কিংবা দু্ম্বার পাল চোখে পড়বে। মরুভূমির মাঝে রাস্তা থেকে বেশ দূরে ক্যাম্পের মতো করে উটের রাখালদের থাকার জায়গা। শুধু জায়গাটিই চলন্ত গাড়ি থেকে চোখে পড়বে, কোনো মানুষ নয়।

তবে, মরুভুমির মাঝে কাঁটা ও গুল্মজাতীয় ছোট গাছ আছে প্রচুর। আবার কোথাও পরম যত্নে লাগানো খেজুরগাছের সারি। ছয় ঘণ্টার পথ এসব দেখতে দেখতেই কেটে যায়। বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসে থাকলেও রাস্তার কোনো ধকল কাউকে পেতে হয় না। এতো চমৎকার রাস্তা।

কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাস্তা এমন ছিলো না। তখনকার দিনে এই পথ ছিলো দুর্গম। ভাবতে অবাক লাগে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতে সময় ও পরে সাহাবাসহ কীভাবে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন!

মক্কা থেকে মদিনার অবস্থান উত্তর দিকে। কিন্তু হিজরতে সময় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিকে না গিয়ে পশ্চিম দিক দিয়ে রওনা হন। যাতে শত্রুরা বুঝতে না পারে। এ জন্য অনেক পথ ঘুরতেও হয়েছে। ওয়াদিয়ে আসফা, আমলাইজ, গাদিদ আলখারার, জাদাজেদ ও সানিয়াতুল ফারজ হয়ে নবী করিম (সা.) মদিনার কুবায মহল্লায় পৌঁছান। এটিই হিজরতের রাস্তা হিসেবে পরিচিত।

এই দীর্ঘ পথ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের সময় অতিক্রম করেছেন কখনও উটে, কখনও ঘোড়ায়, আবার কখনও হেঁটে। ওই যাত্রা ছিলো- দীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল ও কষ্টদায়ক।

মদিনার মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে, মদিনা বরকতপূর্ণ নগরী। এর বরকতের জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি মক্কায় যে বরকত দান করেছেন, তার দ্বিগুণ বরকত মদিনায় দান করুন।’ -সহিহ মুসলিম

মদিনার প্রতি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসা ছিলো অপরিসীম। হজরত আনাস (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে মদিনায় ফিরে আসতেন, তখন দূর থেকে মদিনার ঘরবাড়ি দেখেই তার উটের গতি বাড়িয়ে দিতেন। অন্য কিছুতে আরোহিত থাকা অবস্থায় ভালোবাসার আতিশয্যে তা নাড়াচাড়া শুরু করে দিতেন। -সহিহ বোখারি

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুমাইদ সায়েদি (রা.) বলেন, ‘আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলাম। যখন আমরা মদিনার নিকটবতী হলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এই তো পবিত্র ভূমি। এই তো ওহুদ পাহাড়, যে পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও তাকে ভালোবাসি।’ –সহিহ বোখারি

হজপালন করতে এসে হজযাত্রীরা হজের আগে বা পরে আটদিনের মতো মদিনায় অবস্থান করেন। শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদের বরকতময় স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র শহর মদিনার অলিগলিতে রয়েছে ইতিহাসের অনেক উপাদান।

মদিনার পুণ্যভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব। স্থানটি মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ দিয়ে চিহ্নিত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্রতা ধারণ করে মদিনা চিরধন্য।

তাই মদিনার নাম শোনামাত্রই মুমিনের হৃদয়ের আয়নায় ভেসে ওঠে এক স্বর্গীয় নগরীর ছবি। প্রেম, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধে ভরে যায় মন। কোনো মুমিনের জীবনে আল্লাহর ঘর জিয়ারত ও হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম জানানোর চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি হতে পারে না। এই প্রাপ্তির বর্ণনা দেওয়া মুশকিল, এটা অনুভবের!

মক্কা মরুময় ও পর্বত ঘেরা। মদিনা অনেকটাই সমতল ও সবুজের আলপনা আঁকা। কোলাহলহীন নির্জন শহর। তাবত পৃথিবীর শান্তির রাজ্য এই মদিনা। শহরটিতে পা দিলেই শরীর ও মন শিহরিত হয়ে ওঠে। এই সেই মদিনা। যে শহরের বেশিরভাগ মানুষ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্মান জানাতে, বরণ করতে ছুটে গিয়েছিলেন শহরের শেষ প্রান্তে। তখন শিশুরা গেয়েছিলো- ত্বৃলাআ’ল বাদরু আ’লাইনা। অর্থাৎ সূর্য উদিত হয়েছে আমাদের ওপর….।